ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য
(সংকেত: ভূমিকা; ছাত্রজীবন; ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য; সামাজিক ক্ষেত্রে ছাত্রদের দায়িত্ব ও কর্তব্য; রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দায়িত্ব ও কর্তব্য; পারিবারিক ক্ষেত্রে দায়িত্ব ও কর্তব্য; দেশাত্ববোধ; নিয়মানুবর্তিতা; নৈতিক মূল্যবোধ ও শিষ্টাচার; উপসংহার।)
ভূমিকাঃ “আমরা শক্তি আমরা বল/ আমরা ছাত্রদল/ মোদের পায়ের তলায় মূর্চে তুফান/
ঊর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল/ আমরা ছাত্রদল।”- কাজী নজরুল ইসলাম
ছাত্ররাই
একটি দেশের ভবিষ্যৎ।তাদের দিকেই তাকিয়ে থাকে দেশ ও সমাজ।তারা ভোরের শিশির, প্রভাতের আলোর
মতো নবজীবনের দ্যুতি ছড়ায়। তারা তাদের কর্মে দেশ ও সমাজের সব অনাচার, অবিচার, অসঙ্গতি দূরে ঠেলে দেয়। তাদের মধ্যে রয়েছে
অপার সম্ভাবনা। তারা পারে না এমন কাজ পৃথিবীতে নেই। ছাত্রসমাজ জেগে উঠলে পুরো জাতি,
দেশ ও পৃথিবী জেগে উঠে। তারা তাদের সংগ্রাম দিয়ে যেমন দেশকে সংঘাত
মুক্ত করে তোলে, তেমনি নৈতিকতা, শিষ্টাচার,
সৌজন্যতা দিয়ে দেশকে সুখী ও সুন্দর করে তোলে।
·
ছাত্রজীবনঃ অধ্যায়নের
জীবনটাই ছাত্রজীবন। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে
দেশের বাইরে বিভিন্ন গবেষণামূলক অধ্যয়নের সবটুকুই ছাত্রজীবনের অন্তর্ভুক্ত।ছাত্রজীবনের
সংজ্ঞা এভাবে করা যায় যে,’’Student
life means the life which is totally used for study and to acquire knowledge
and virtues’’ একজন ছাত্র কোনো কিছুতেই পিছপা হয় না।“ভাবনার জগতের সাথে একাত্ম
হওয়া –
এটাই হলো শিক্ষা।“ – এডিথ হেমিলটন।ছাত্রজীবন মানুষের জীবনের
শ্রেষ্ঠ সময়। ছাত্রজীবনেই মানুষ ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত গড়ে তোলে।জীবনকে প্রাণ প্রাচুর্যে
ভরে তোলার শিক্ষা মানুষ ছাত্রজীবন থেকে পায়।বদান্যতা, সততা,
ন্যায়-নিষ্ঠা, নিয়মানুবর্তিতা, দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ, মহানুভবতার
শুরু ছাত্র জীবন থেকেই। প্রতিটি ছাত্রই দেশগড়ার হাতিয়ার। ভবিষ্যতে তারাই দেশের
নেতৃত্ব দিবে। মহাত্মা গান্ধীজি বলেন, "The students are the Future
leaders of the country who could fulfill country's hopes being capable."
ছাত্রদের দায়িত্ব ও কর্তব্যঃ “ছাত্র নং অধ্যয়নং তপ” এটিই ছাত্রদের মূলমন্ত্র। সংস্কৃত এই কথাটির অর্থ-
অধ্যয়নই ছাত্রদের একমাত্র তপস্যা। ছাত্রজীবন মানেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগৎ। যেখান থেকে ছাত্ররা প্রতিনিয়ত
নতুন কিছু শিখবে।আর এ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে কর্মমুখী জীবনে প্রবেশ করবে।স্বাস্থ্যকর, মানসম্পন্ন,
সুন্দর পরিবেশে কাজ করতে চাইলে ছাত্রজীবন থেকেই সেই মানসিকতা গড়ে
তুলতে হবে। ছাত্রজীবনে পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই। তার পাশাপাশি মানুষ্যত্ববোধও
অর্জন করতে হবে। শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে। শিক্ষকের আদেশ পালন
করলে একটি ছাত্র অবশ্যই ভালো গুণের অধিকারী হতে পারবে। কেননা শিক্ষকই একটি ছাত্রকে
সৎ ও মেধাবী করে তোলে।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, "None but those who have the spirit
of forbearance are fit to be teacher." তাই শিক্ষককে
সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে আসীন করতে হবে। ছাত্রদের অন্যতম প্রধান কর্তব্য শুধুমাত্র
পাঠ্যপুস্তকে সীমাবদ্ধ না থাকা। পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও অনেক কিছু শেখার রয়েছে যা
তাদেরকে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করবে।
সামাজিক ক্ষেত্রে ছাত্রসমাজের দায়িত্ব ও
কর্তব্যঃ একটি দেশের সচেতন নাগরিক
হচ্ছে ছাত্রসমাজ। অধ্যয়ন ছাত্রদের মূল লক্ষ্য হলেও সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের অনেক
দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। তারাই দেশকে সঠিক পথ অনুসরণে সহায়তা করতে পারে। আমাদের
দেশে এমন অনেক দরিদ্র সুবিধাবঞ্চিত পরিবার রয়েছে যেখানে একটি মাত্র সদস্য শিক্ষিত।
সেই সদস্যটি পুরো পরিবারে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি শিক্ষার
অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলে।শুধু পরিবার কিংবা সমাজ নয় ছাত্রসমাজকে পুরো
জাতির নিরক্ষরতা দূরীকরণে সহায়তা করতে হবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেখানে জনসংখ্যা
বৃদ্ধির হার মারাত্মক আকার ধারণ করছে সেসব দেশের ছাত্রসমাজের উচিত সংঘবদ্ধভাবে
জনগণকে পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে এবং অধিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কুফল সম্পর্কে
সচেতন করে তোলা। সমাজকে এবং শিক্ষাঙ্গনকে সন্ত্রাসমুক্ত করার দায়িত্ব ছাত্রদেরই
কাঁধে নিতে হবে। আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোর কারণে শিক্ষার্থীদের
পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান দেওয়া সম্ভব হয় না ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু
ছাত্রসমাজের উচিত নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি করা। শিক্ষিত যুবকরা যদি কৃষি কাজ, মৎস্যচাষ, পশুপালন,
নার্সারি ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের মেধা ও শ্রমকে কাজে লাগায় তাহলে
দেশের উন্নয়ন যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি বেকারত্বও হ্রাস পাবে।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দায়িত্ব ও কর্তব্যঃ ছাত্রসমাজ
অনাচার,
অবিচার, অত্যাচার ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সবসময়ই
সোচ্চার। আদর্শগতভাবেই তারা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। রাজনীতির বিষবৃক্ষের মূলোৎপাটন করা ছাত্রদের দায়িত্ব
ও কর্তব্য।যুগে যুগে ছাত্রসমাজ দেশের স্বাধীনতা অর্জনে এবং স্বাধীনতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ
অবদান রেখে যাচ্ছে।শিক্ষিত, ব্যক্তিত্ববোধসম্পন্ন
ছাত্রসমাজ কখনো পরাধীনতার গ্লানি বয়ে বেড়াতে চায় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা
সংগ্রামে ছাত্রদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তাছাড়া মাতৃভাষার জন্য তারা যে ত্যাগ
স্বীকার করেছে তা ইতিহাসের পাতায় বিরল। ১৯৬২ সালের হামিদুর রহমানের শিক্ষা কমিশনের
বিরুদ্ধে আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রসমাজ গৌরবময় ভূমিকা পালন করেছিল। তবে বর্তমানে
ছাত্ররা রাজনীতির প্রকৃত আদর্শ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে সন্ত্রাসবাজি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন দুষ্কৃতিমূলক কাজে জড়িয়ে নিজেদের মেধাকে নষ্ট করে
ফেলছে।
পারিবারিক ক্ষেত্রে দায়িত্ব ও কর্তব্যঃ "Charity
begins at home" ছাত্ররা পরিবারের কাছ থেকে যেমন অনেক কিছু পায়
তেমনি পরিবারের প্রতিও তাদের অনেক দায়িত্ব থাকে। পরিবারের সকলেই তাদের কাছ থেকে
ভালো আচার ব্যবহার প্রত্যাশা করে। আব্বু-আম্মু এবং পরিবারের বড়দের প্রতি সম্মান
প্রদর্শন করা, ছোটদের প্রতি স্নেহ করা তাদের কর্তব্য।
দেশাত্মবোধঃ ছাত্ররা দেশপ্রেমকে তাদের অন্তরে লালিত করে। তারা দেশপ্রেমে
উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের জীবন পর্যন্ত বাজি রাখতে পারে দ্বিধাহীনভাবে। ছাত্রদের দেশের
ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকায় তারা দেশকে আরও বেশি আপন করে নিতে
পারে। ছাত্রসমাজ মানেই তরুণ সমাজ। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর এই তরুণসমাজকে দেশের ও
দেশের মানুষের সেবায় মগ্ন থাকতে হবে। তাদের মধ্যে কোনো ক্লান্তি, কোনো
দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকা উচিত নয়। বন্যা-দুর্গত, ঝড়ে কবলিত
এলাকায়, দুঃস্থ মানুষের পাশে সবসময় তাদের সেবার হাত বাড়িয়ে
দিতে হবে।
নিয়মানুবর্তিতাঃ "Work
while you work, play while you play, And that is the way to be happy;"-এ নীতি মেনে চললে ছাত্ররা তাদের সাফল্যের চরম শিখরে আরোহণ করতে পারবে।
ছাত্রদের প্রথম কাজ পড়াশোনা। কখনোই তাদের একদিনের কাজ অন্যদিনের জন্য রেখে দিলে
চলবে না। ব্যক্তিজীবনে, সমাজ জীবনে, রাজনৈতিক
ক্ষেত্রে ছাত্রদের অবশ্যই নিয়মানুবর্তিতার সাথে সুষ্ঠুভাবে তাদের দায়িত্ব ও
কর্তব্য পালন করতে হবে। ছাত্রজীবন থেকেই নিয়মানুবর্তিতায় বেড়ে উঠলে কর্মজীবনও এর
প্রভাব পড়বে।
নৈতিক মূল্যবোধ ও শিষ্টাচারঃ শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের শুধু পরীক্ষা পাসের শিক্ষাই দেওয়া হয় না। তাদেরকে নৈতিক
মূল্যবোধ এবং শিষ্টাচারের শিক্ষা দেয়া হয়। নৈতিক মূল্যবোধ ছাত্রকে সৎ, কর্তব্যনিষ্ঠ,
নিয়মনিষ্ঠ, পরিশ্রমী সর্বোপরি সুন্দর
চরিত্রের অধিকারী করে তোলে। প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠার
জন্য চাই নৈতিকতা। শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধ ছাত্রসমাজকে নম্র-ভদ্র ও নির্মল চরিত্রের
অধিকারী করে। পরিবারের সকলের প্রতি, শিক্ষকদের প্রতি,
সহপাঠীদের প্রতি মার্জিত আচরণে ছাত্ররা সকলের কাছ থেকে ভালোবাসা,
দোয়া এবং সাহায্য-সহযোগিতা পায়। নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন এবং
শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধসম্পন্ন ছাত্রসমাজই পারে ভবিষ্যতে জাতির সুষ্ঠু নেতৃত্ব
দিতে। তাই ছাত্রদের শিষ্টাচার ও নৈতিক মূল্যবোধের গুণে অর্জন করতে হবে।
উপসংহারঃ দেশ
ও জাতি সৎ,
চরিত্রবান, নিয়মনিষ্ঠ, কর্তব্যপরায়ণ,
সৌজন্যবোধসম্পন্ন পরিশ্রমী ছাত্রসমাজের কামনা করে। সাম্প্রতিককালে
ছাত্রসমাজ আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে বিভিন্ন ধরণের অপরাধমূলক কাজ করছে।
ছাত্র-রাজনীতির নামে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। যা দেশ ও জাতির কাছে মোটেও
কাম্য নয়। এভাবে চলতে থাকলে জাতি শেকড়হীন হয়ে পড়বে। তাই ছাত্রসমাজের উচিত তাদের
প্রকৃত আদর্শে আলোকিত হওয়া। যে শিক্ষা ও মূল্যবোধ ছাত্ররা অর্জন করে ভবিষ্যতে তা
পরিপূর্ণ ভাবে কাজে লাগানো, ছাত্রদের প্রকৃত উদ্দেশ্য হওয়া
উচিত।
তাই আমাদের ব্রত হওয়া উচিত এমনই,
“ছাত্র
হয়ে গড়ব দেশ
স্বপ্নের সেই সোনার বাংলাদেশ
যাতে
ভেসে ভেসে একদিন চূড়ান্ত হবে এ শিক্ষা
তারপরই
হবে আমার ছাত্রজীবন শেষ,
তার
পূর্বে কোন ছুটি নেই,থাকবে না কোন অবসর!”
Comments
Post a Comment